Translate

দুই বাংলাদেশি তৈরি করলেন সৌরশক্তি চালিত রিকশা!!!

আসছে সৌরশক্তিচালিত রিকশা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. এম শামীম কায়ছার ও মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রভাষক আবু রায়হান মো. সিদ্দিক মিলে তৈরি করেছেন ৭০ হাজার টাকা দামের এই রিকশা।
২০০৯ সাল। দিল্লি সফরে গিয়েছেন ড. শামীম কায়ছার। দিল্লির পথে পথে একদিন হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল, যাত্রী নিয়ে চলছে রিকশা। চালকের আসনে আরাম করে বসে আছেন রিকশাওয়ালা। প্যাডেল মারতে হচ্ছে না। অন্য রকমের এই রিকশা দেখে কৌতূহল হলো। খোঁজখবর করে জানলেন, রিকশাগুলো ব্যাটারিচালিত, চার্জ দিতে হয় বিদ্যুতে। একবারের চার্জে চলে পুরো দিন।
left সঙ্গে সঙ্গে আফসোস হলো- ইস্, আমাদের দেশে যদি এমন রিকশা বানানো যেত, তাহলে তো রিকশাচালকদের খাটুনি কমে যেত। পরক্ষণেই বিদ্যুৎ সমস্যা আর লোডশেডিংয়ের কথা মনে করে দমে গেলেন। তবে ভাবনাটি ছেড়ে গেল না তাঁকে। দেশে ফিরেও বিকল্প আর কী উপায়ে পরিশ্রম ছাড়াই রিকশা চালানো যায় ভাবতে লাগলেন। তত দিনে বছর ঘুরে গেছে, এ দেশেও নেমেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। তবে বিদ্যুতের অপচয় হয় বলে লাইসেন্স পেল না।
এর মধ্যেই সৌরশক্তিচালিত রিকশা বানানোর পরিকল্পনা তৈরি করে ফেললেন ড. শামীম। সহকর্মী-বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। উৎসাহ দিলেন সবাই। কাজে নেমে পড়ার আগে তাঁর মনে হলো, ‘রিকশাচালকের ওপর কিছু গবেষণা হওয়া দরকার।’ রিকশাচালকদের ওপর বেশ কটি গবেষণা করলেন ড. কায়ছার। গবেষণার ফলাফল আঁতকে ওঠার মতো!
তিনি বললেন, ‘প্রতিদিন গড়ে আট থেকে ৯ ঘণ্টা রিকশা চালানোর ফলে একেকজন রিকশাচালকের প্রতি মিনিটে শক্তি খরচ হয় গড়ে ২৩ থেকে ২৬ কিলো জুল। টানা ১০ বছর রিকশা চালানোর ফলে বেশির ভাগ চালকের ডিএনএ গঠন ভেঙে পড়ে, হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।’
ফলে এসব চালকের জন্য আরো সহজ এবং পরিবেশবান্ধব রিকশা তৈরির ভাবনাটি পেয়ে বসল তাঁকে। এ সময় হঠাৎ করে পাওয়া একটি সুযোগও এসে গেল তাঁর কাছে। বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালের বিজ্ঞান গবেষণা হিসাবে ড. কায়ছারের এই প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দিতে সম্মত হলো।
সৌরশক্তির রিকশা তৈরির জন্য গবেষণায় এক লাখ টাকা অনুদান পেলেন ড. কায়ছার। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন তাঁর প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমানে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির প্রভাষক আবু রায়হান মো. সিদ্দিক। দুজনে মিলে তৈরি করলেন সৌরশক্তিচালিত রিকশা।
যেভাবে উৎপাদিত হবে শক্তি
ড. শামীম কায়ছারের উদ্ভাবিত এ রিকশায় শক্তি সরবরাহ করবে দুটি সৌর প্যানেল। এগুলো থাকবে রিকশার হুডের ওপর। সূর্যালোক সংগ্রহ করে প্যালেন দুটি সে শক্তি সরবরাহ করবে ব্যাটারিতে। ড. কায়ছার বললেন, ‘রিকশা চালাতে সাধারণত ৪৮ ভোল্ট শক্তি লাগে। তবে আমাদের দুটো সোলার প্যানেল ২৪ ভোল্ট শক্তি উৎপাদনে সক্ষম।
এ জন্য একটি কনভার্টার ব্যবহার করেছি, যা ২৪ ভোল্টকে ৪৮ ভোল্টে রূপান্তরিত করে। এটা চারটা সোলার প্যানেল বসিয়েও করা যেত। তবে তাতে অনেক জায়গা লাগত। রাস্তার ঝাঁকুনিতে সেগুলো পড়ে গিয়ে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও ছিল।’
চট্টগ্রামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুদিন আগে সৌরশক্তির রিকশা বাজারজাত করার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে নানা সমস্যায় আটকে গিয়ে তাঁরা সেগুলো বাজারে আনতে পারেনি। ‘ওদের রিকশায় চারটি প্যানেল ছিল। তবে মাইক্রোকন্ট্রোলার ছিল না। ফলে নানা সমস্যা হতো। আমরা এসব সমস্যা কাটিয়ে সহজ পদ্ধতিতে এটা তৈরি করতে পেরেছি’, বললেন ড. কায়ছার।
আছে নানা সুবিধা
‘আমাদের দেশে গরমকালে গড়ে ৮.০৩ পরিমাণ সৌরশক্তি থাকে; শীতকালে ৫.০৫। সরা বছরের হিসাবে আমরা প্রতিদিন গড়ে ৪-৬.০৮ সৌরশক্তি পেয়ে থাকি। এ প্রাকৃতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে রিকশা চালানোই আমাদের বড় সাফল্য’- জানালেন ড. কায়ছার। উদ্ভাবক জানালেন, আমাদের রিকশায় মাইক্রোকন্ট্রোলার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে শক্তি সঞ্চয়সহ অনেক কিছুই করা সম্ভব।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, ‘যখন রিকশায় যাত্রী থাকেন না, তখন এ মাইক্রোকন্ট্রোলার দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করা যাবে। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোটর থেকে ব্যাটারিতে শক্তি সরবারহ বন্ধ থাকবে। এতে রিকশার গতি কমে যাবে, আর সৌরশক্তি ঠিকই সঞ্চিত থাকবে। শক্তি সরবরাহ কখন চালু বা বন্ধ হচ্ছে, চালক সেটি বুঝতেও পারবেন না। মাইক্রোকন্ট্রোলার দিয়ে রিকশার একটা নির্দিষ্ট গতিও নির্ধারণ করে দেওয়া যায়। এতে চালক ইচ্ছা করলেও বেশি গতি তুলতে পারবেন না।’
এ প্রসঙ্গে আরেক গবেষক আবু রায়হান মো. সিদ্দিক বললেন, ‘গবেষণার মাধ্যমে এর কার্যকারিতা আরো বাড়ানো সম্ভব। আমরা প্রথমবারের মতো রিকশায় মাইক্রোকন্ট্রোলার সফলভাবে ব্যবহার করতে পেরেছি। মাইক্রোকন্ট্রোলারের মাধ্যমে মোটরের এনার্জি ইনপুট নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাটারি চার্জের স্থায়িত্ব আরো বাড়ানো সম্ভব। তখন হয়তো টানা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টাও চালানো যাবে।’ এখন সৌরশক্তিচালিত রিকশাগুলো চার্জের পর টানা সাত থেকে আট ঘণ্টা চলে।
কয়েক দিন যদি টানা কুয়াশা থাকে, সূর্যের মুখ দেখা না যায় বা মুষলধারে বৃষ্টি নামে, তাহলে কিভাবে ব্যাটারিতে চার্জ হবে- এ প্রশ্নের জবাবে ড. কায়ছার জানালেন, ‘এ সমস্যার কথা মাথায় রেখেই জরুরি অবস্থায় বিদ্যুতের মাধ্যমে ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার সুবিধা রাখা হয়েছে।
ফলে এ উপায়ে সৌরশক্তির পাশাপাশি প্রচলিত পদ্ধতিতেও বাটারি চার্জ করা যাবে।’ তাহলে কি সৌরশক্তির ওপর ভরসা না করে বিদ্যুতে চার্জ দিতে আগ্রহী হবেন না চালকরা- এ প্রশ্নের জবাবে আবু রায়হান মো. সিদ্দিক বললেন, ‘বিদ্যুতে নিয়মিত চার্জ দিলে খুব দ্রুত ব্যাটারি নষ্ট হয়। ফলে নিজের স্বার্থেই চালকরা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদ্যুতের আশ্রয় নেবেন না।’
সৌরশক্তি ব্যবহারের সুবিধাও উপস্থাপন করা হয়েছে ড. কায়ছারের গবেষণায়, ‘সৌরশক্তির রিকশা চালু হলে দিনে অন্তত ২০০-২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।’ ড. কায়ছার বললেন, ‘নিষিদ্ধ হলেও সারা দেশেই ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিদ্যুতের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, একটি অটোরিকশা বছরে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ গ্রহণ করে, তাতে বছরে ১৪ হাজার ২৩৪ টাকার বিদ্যুতের অপচয় হয়।’
আগামী বছর আসছে বাজারে
সফলভাবে উদ্ভাবনের পর এখন সৌরশক্তিচালিত রিকশাগুলো নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ড. কায়ছার জানালেন, ‘আগামী বছর বাণিজ্যিকভাবে সৌরশক্তির রিকশা উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে। তিনি বললেন, ‘এটা আমার একটি স্বপ্নপূরণ হওয়ার মতো ব্যাপার। হঠাৎ ভেবেছিলাম যে প্রযুক্তির কথা, সেটি হাতে-কলমে করে দেখালাম। এখন তা বাণিজ্যিকভাবে তৈরির চিন্তা করছি। তবে এ জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামের কথাও বলতে হয়। নানাভাবে সাহায্য করেছেন তিনি।’ ড. কায়ছার মনে করেন, দামটাও হাতের নাগালে থাকায় সবাই এই রিকশা কিনতে আগ্রহী হবেন। তিনি বলেন, ‘প্রচলিত রিকশার ব্যাটারি কিনতেই ৭০ হাজার টাকা খরচ পড়ে। সৌরশক্তিচালিত রিকশা উৎপাদনেও খরচ তেমনই। ফলে অবশ্যই ভালো সাড়া পাব।’
তারপর সৌরশক্তিচালিত গাড়ি
সৌরশক্তিচালিত রিকশা প্রকল্পের পর ড. এম শামীম কায়ছারের স্বপ্ন সৌরশক্তিচালিত গাড়ি। তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন বিভাগের আরেক শিক্ষক শামীম আল মামুন। ছোট্ট এ গাড়ি তৈরির খরচ পড়বে মাত্র এক লাখ টাকা। এ বিষয়ে জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘প্রকল্পটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে গেছি। আশা করি, এ বছরের মাঝামাঝি তৈরি করে ফেলব। আমাদের ইচ্ছা, সৌরশক্তিচালিত চালকবিহীন গাড়ি তৈরি। প্রাথমিকভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সফলভাবে চালাব। সাফল্য পেলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি করব।’
Share on Google Plus

About Unknown

    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রিয় পাঠক, আপনার একটি মন্তব্য একজন লেখক কে ভালো কিছু লেখার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ যোগায় তাই প্রতিটি পোস্ট পড়ার পর নিজের মতামত/মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না।পোস্টটি পড়ার পর আপনার ভাল-লাগা,মন্দ-লাগা,জিজ্ঞাসা কিংবা পরামর্শ প্রদানের জন্য দয়া করে গঠনমূলক মন্তব্য প্রদান করবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।আপনার একটি মন্তব্যই আমার নিকট অনেক মূল্যবান।আসসালামু আলাইকুম...